Skip to main content

জুগুলুবাম্বা তৃতীয় পর্ব

কুকুরেরা কেন মানুষের বন্ধু হল

সুদানের গল্পদাদু তালিদালা তাঁর পশমের টুপিটা তুলে তাঁর হাত মাথার উপর ধীরেসুস্থে বুলিয়ে দিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। সামনের উঠানে পায়রার মতো সুদানি ছোট ছোট পাখি লাফালাফি করে খেলছিল। তাদের মধ্যে একটা পাখি লাফ দিয়ে ছোট শস্যদানার গামলার উপর বসে মহানন্দে মলত্যাগ করল। ওদিকে ছাই রঙ্গা পোশাক পরে তাঁর বৌ মজাছে শস্যদানা চিবাচ্ছিল। মলত্যাগ করে পাখিটা মাটিতে পা ফেললো। লালটুপি পরা মাথাটি চারদিক ঘুরে দেখে একটা গাছের ডালে উড়ে গেল। অন্যান্য পাখিগুলিও তাঁর দেখাদেখি পেছন পেছন গাছের দিকে উড়ে গেল।

বালিরঙা একটা শুটকো কুকুর বাড়ির কোনা থেকে বেরিয়ে এলো আর তালিদালার দিকে এগিয়ে এল। তালিদালা পা মুড়ে বসেছিল কারিতে গাছের ছায়ায়। কারিতে গাছের পাতা অসম্ভব সবুজ। তার ফল দিয়ে সুস্বাদু মাখন তৈরি হয়। তালিদালা কুকুরটার দিকে পাশ ফিরলেন
‘আরে এই কুত্তা, তুই এখানে? আয় আমার পাশে শুয়ে পড়। তুই জানিস কেমন করে আমাদের পূর্বপুরুষরা পরস্পরের বন্ধু হল’?
কুকুরটি গুটশুটি মেরে বসলো এবং একাগ্রচিত্তে তালিদালার দিকে চেয়ে রইলো। বৃদ্ধ গল্প শুরু করলো।
ছবিঃ
কোন এক সময় মানুষেরা ঝোপঝাড়ে থাকত, বুনো খরগোশ এবং চড়ুই পাখির মত। আর যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত, তখন তারা ধুলোবালির মধ্যে লুকিয়ে পড়তো।
গল্পো শুরু করার সাথে সাথে গ্রামের বাচ্চারা তাদের খেলা বন্ধ করে দিল। তারা উঠে এসে তালিদালার কাছে এল। তাদের চোখে জ্বলছে কৌতুহলের আগুন।
সেকালে লোকদের মাথার ওপর ছাদ ছিল না। তারা খোলা আকাশের নিচে এখানে সেখানে শুতো জন্তু জানোয়ারের মতই।
একদিন একটা লোক একজন কুকুরের দেখা পেল। সে তার বন্ধু হয়ে গেল। কুকুরটিও লোকটিকে ভালোবাসত যেমন কিনা লোকটি কুকুরটিকে। তারা একসঙ্গে চলে গেল পাহাড়ের একটা গুহাতে বসবাস করতে। গুহাটি ছিল সরু আর অন্ধকার।
একদিন সকালে কুকুরটি রাস্তা দিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল :
লোকটির যা দরকার তা হল সমস্ত শরীর বিছিয়ে দারুণ ঘুম। যে অন্ধকার গুহাটি জন্তুরা ছেড়ে চলে গেছে সেখানে দ’য়ের মত শরীর ভাজ করলে তার ঘুম কোন দিনও ঠিক হবে না। যদি ওকে নতুন করে ঘুমোতে হয়, তাহলে তার একটা নতুন বসতবাড়ি দরকার শান্তি পাওয়ার জন্য। স্বপ্নের মধ্যে নতুন ভাবনা আনার জন্যও তা দরকার।
যদি মানুষটির নতুন ঘুম হয় তাহলে নতুন ভাবনাও আসবে। তাকে অন্য ধরণের জিনিসও খেতে হবে। শিকার থেকে সে যা পায় শুধু তা খেলে চলবে না। তাকে আরও নতুন জিনিসের সন্ধান করতে হবে।
যখন সে এগুলি পেয়ে যাবে তখন তাকে রক্ষা করার জন্য কারও দরকার হবে। তাকে বলতে সে, তার নিদ্রা, তার বসতবাড়ি এবং তার চিন্তার স্রোত। আমি তার বন্ধুআমি ওকে এসব কিছু দেব। তারপর তাকে পাহারা দেব বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য।
এই সব ভাবতে ভাবতে কুকুরটি মাথা নিচু করল। তার নজর পড়ল শস্যদানার খড়ের মাথায় ওঠা একটা পোকার দিকে। সে লক্ষ্য করল যে, দানাটা পেকে গেছে।
পোকাটা দানাটি নিয়ে কেটে পড়ল। দানাটা একটা ছোট শুকনো চীৎকার করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। একটা পিপঁড়ে দ্রুত সেটা নিয়ে ভেসে গেল। কুকুরটি থেমে পড়ল:
‘এই পিপঁড়ে! তোমাকে আমার ধন্যবাদ জানানো উচিৎ। তুমি এই যবের দানাটা নিয়ে এসে আমাকে এইমাত্র একটা চমৎকার উপদেশ দিলে’
‘আমি’? পিপঁড়ে বলল। ‘যবদানাটিকে জাপটে ধরে নিয়ে আসার জন্য! আমি’?
‘হ্যা, তুমি আমাকে যবের দানা ভর্তি একটা বড় গামলা দিতে পার? পরিবর্তে লোকটি তোমাকে তার শ্রমের প্রথম ফসল, একপাত্র মধু দেবে’
‘তোমার প্রতিশ্রুতি ভালোই শোনাচ্ছে। বন্ধু সারমেয়। তোমাকে আমি বিশ্বাস করি। তুমি আমাকে একটা বড় গামলা এনে দাও। কাল এটা ভর্তি পাবে’
‘বারকালা, দারুণ। আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি’
তারপর সে লোকটির সঙ্গেদেখা করতে ফিরে গেল। সন্ধ্যে হয়ে এল। কুকুরটি চলল যবদানার গামলার সামনে। লোকটির সামনে গামলাটি রেখে সে বলল:
‘এটা তোমার জন্য। তোমাকে এটা আমি দিলাম’
লোকটি হতবাক হয়ে বলল:
‘যবদানা, যবের দানা! কী করব এটা আমি নিয়ে’?
‘এগুলি মাটিতে রাখতে হবে। তাদের সেবা করতে হবে, তাদের রক্ষা করতে হবে’
‘কী করে’?
‘এসো, আমার পেছনে পেছনে এসো। আমরা এক্ষুণি কাজ শুরু করব। আমি মাটি খুঁড়তে থাকব আর তুমি পাথরগুলি তুলতে থাকবে। তারপর যখন যবপোতার ঋতু আসবে তখন দানাগুলি আমরা মাটিতে পুতে ফেলব। গোটা ক্ষেত ঢেকে ফেলব শস্যবীজে। শেষমেশ, আমরা ফসল তুলব। তুমি মৌমাছির মতই কাজ করবে কিন্তু তোমার মধু হবে সোনামাটির বীজ যা তুমি খেতে পারবে’
‘বেশ তবে তাই হোকলোকটা বলল।
এরপর শুরু হল ক্ষেত পরিষ্কার করা। বাজে আগাছা আর নুড়ি পাথর সরিয়ে ফেলা। লোকটি দাবা নামে একটা মাটি খোঁড়া আর আগাছা পরিষ্কার করার একটি যন্ত্র বানিয়ে ফেলল। তারপর সে বুনলো শস্যদানা আর সেই সময় কুকুরটি তার নাক দিয়ে বীজবোনার লাইনে খুব হালকা করে মাটি সরাতে লাগল।
ছবি............
যবদানা মাটি ভেদ করে বেড়ে উঠল। শীগগীরই যব গাছ পেকে উঠবে। লোকটির বৌ একটা হামান দিস্তা বানিয়েছে, যেখানে সেই যবদানা গুড়ো করবে।
শেষ পর্যন্ত দিন এল, যখন যবের সুপ প্রথমবার একত্রে খাবার সুযোগ দেখা দিল।
লোকটির বৌ, মহিলাটি, যে নিজেকে বদলাতে ভালোবাসেন, সে এরপর কিছু দেরিতে রুটি করতে বসবে।
আরও একদিন এমন এল যখন লোকটিকে তার ফসল রাখার মত শুকনো জায়গা খুজতে হল। যবের খড় দিয়ে সে ছাদ তৈরী করল। মাটি পুড়িয়ে এরপর ইট বানাতেও সে শিখল। তা দিয়ে সে এইভাবে বাড়ি করতে জানল।
তার বাড়িতে সে বাবুই ঘাসপাতা দিয়ে বানাল এক বিছানা, ঘুমাবার জন্য। সে তার জিনিসপাতি গুছিয়ে রাখতে জানল। তার বৌ আগুন বানাবার জায়গা আলাদা করে রাখল, একটা বড় পাথর দিয়ে। ভেড়ার চামড়া দিয়ে তৈরী বস্তায় লোকে জল আনত। আর তারপর সেই বস্তা ছাদে ঝুলিয়ে রাখত।
বাড়ি নির্মান হল, ক্ষেতে ফসল ফললো। পিঁপড়েকে একপাত্র যবদানা দেওয়া হল বেতন হিসাবে।। লোকটি অন্য সবার সাথে শান্তিতে নতুন করে ঘুমোতে শিখল। আর আগামী ফসলের জন্য স্বপ্ন দেখতে জানল।
তাই কুকুর লোকটির বাড়ির সামনে ঘুমিয়ে পড়ে এবং তাকে কোনদিন ছেড়ে যায় না।
এইভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা বন্ধু হয়েছিল। তালিদালা তার পাইপ ভরাতে ভরাতে গল্প শেষ করল।
কুকুর তার গল্প শুনে ধন্যবাদ জানাল।
বারকালা! বারকালা!
যারা এই গল্প শুনেছিল তারা স্মরণ করবে, বুড়ো লোকটা ছোটো ছোট বাচ্চাদের নতুন দাঁতের হাসি দেখে কী চিৎকারই না করত। শিশুদের শক্ত পায়ে দাঁড়াতে দেখে, তাদের গীতিময় সুর শুনে এবং কৌতূহলী ছোট ছোট নাক দেখে তালিদালা আনন্দে বলে উঠল,

‘হাসো! ছোট ছোট মানুষরা। হেসে নাও, কিন্তু একথা ভুলোনা যে কুকুর আমাদের বন্ধু’।

Comments

Popular posts from this blog

জুগুলুগুবাম্বা, চতুর্থপর্ব

ব্যবসায়ীরা  ব্যবসায়ী? সেরকম কোন কথাই ছিল না সেযুগে। বেচা-কেনা এবং টাকা রোজগারের জন্য একজন লোক তার মগজের চিন্তাকে রূপ দিয়ে তার পুরো পরিবারকে গোটা দুনিয়ার কাছে পাঠিয়েছিল। এই কাহিনীটি বেশ লম্বা। শোনো তবে...  নিজ্যেরএ (নাইজিরিয়ায়) কোন এক কৃষকের একটি মেয়ে ছিল। তার স্বভাব ছিল মিষ্টি, চামড়া ছিল সিল্কের মত, চোখ কালো হরিণের মত। এত সুন্দর হাসিখুসি শিশু যে ভাবাই যায় না। কৃষক মেয়েকে কোন গরিব লোকের হাতে তুলে দিতে চাইত না। একজন বড়লোক জামাই পাওয়ার জন্য সে কি করেছিল সেই গল্পটা শোন তাহলে...  সে তার কন্যাকে একটা নাম দিয়েছিল। কিন্তু কেউই, কোন পুরুষ বা স্ত্রীলোক এমনকি কোন প্রাণীও জানত না সেই নাম।  এরপর সে বলল, যে আমার মেয়ের নাম খুঁজে বার করতে পারবে, সেই হবে আমার ভাবী জামাই। সমস্ত দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে দলে দলে যুবকেরা কৃষকের জামাই হওয়ার আকাঙ্খায় কন্যা ও তার পিতার জন্য উপহার বগলদাবা করে একে একে হাজির হতে লাগলো। সারাদিন ধরে তাদের চলল মদ্যপান আরা হাসাহাসি। পৃথিবীতে জন্মাবার পর যতগুলি নাম তারা শিখেছে এক এক করে সবগুলি তারা বলে গেল। একজন যখন বলছে তখন অন্যরা মজায় হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের ঘাড়ে। কিন্তু ক

জুগুলুগুবাম্বা

কালো মানুষের দেবতা উয়েন্দে পাখিদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা বেশ বন্ধনহীন জীবন কাটাচ্ছ। আর সব সময় চাইলেই শস্যদানা খুঁজে পাচ্ছ। পোকামাকড় খেয়ে বেশ তো মজায় আছো। তোমরা তোমাদের ঠোঁটে নিজেদের গান নিয়ে এসেছো। মাটিতে থাকার চাইতে আকাশেই তো বেশি সময় তোমরা উড়ে বেড়াচ্ছ স্বপ্নের ভেলা ভাসিয়ে'।